জীবনের নানা ব্যর্থতা, লোক লজ্জার ভয়, মানুষের অবমূল্যায়ন কিংবা রোগ-শোকের তীব্রতায় অনেকে আত্মহত্যার পথ বেছে নেয়। মূলত সব ধরনের যন্ত্রণা থেকে মুক্তির আশায় সর্বশেষ পদক্ষেপ হিসেবে আত্মহত্যাকে বেছে নেয় তারা। সংশ্লিষ্ট বিষয়টি যখন তাকে বারবার পীড়া দিতে থাকে তখন সে প্রথমত পরিত্রাণের উপায় খুঁজতে থাকে, ইতিবাচক কোনো দিক না পেয়ে অবশেষে সে মনে মনে ভাবে ‘এত কষ্ট নিয়ে পৃথিবীতে বেঁচে থাকার কী সার্থকতা? হৃদয়ে এত অশান্তি পুষে বেঁচে থাকার তো কোনো মানে হয় না!’ সুতরাং এই জীবন নামক প্রদীপটিকে নিভিয়ে দিলেই সব ঝামেলা চুকে যাবে। কিন্তু প্রশ্ন হলো- আসলেই কি সব ঝামেলা চুকে যাবে এই আত্মহত্যায়? না। এ যেন নিজ হাতেই মহাসঙ্কটের নতুন এক দিগন্তের উন্মোচন। আত্মহত্যাই সঙ্কটের সমাধান নয়, বরং পরকালীন জীবনের যন্ত্রণাদায়ক আজাবের সূচনা হয়।
আত্মহত্যা সম্পর্কে হাদিসে কঠিন ধমকি এসেছে, হজরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত- রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি নিজেকে পাহাড়ের ওপর থেকে নিক্ষেপ করে আত্মহত্যা করে, সে জাহান্নামের মধ্যে সর্বদা ওইভাবে নিজেকে নিক্ষেপ করতে থাকবে। যে ব্যক্তি বিষপান করে আত্মহত্যা করেছে সেও জাহান্নামের মধ্যে সর্বদা ওইভাবে নিজ হাতে বিষপান করতে থাকবে। যেকোনো ধারালো অস্ত্র দ্বারা আত্মহত্যা করেছে তার কাছে জাহান্নামে সে ধারালো অস্ত্র থাকবে যার দ্বারা সে সর্বদা নিজের পেটকে ফুঁড়তে থাকবে।’ (বুখারি : ৫৭৭৮)। যদিও ঈমান থাকা অবস্থায় মারা গেলে পাপের শাস্তি শেষে আল্লাহ তায়ালা চাইলে মুক্তি দেবেন। বস্তুত পরকালীন দীর্ঘমেয়াদি কঠোর শাস্তির তুলনায় পার্থিব জীবনের দুঃখ-ক্লেশ অতি নগন্য। তা হলে সামান্য কষ্টের বিপরীতে জাহান্নামের কঠিন শাস্তিকে ডেকে আনা কি কখনও বুদ্ধিমানের কাজ হতে পারে?
আসলে এই প্রশ্নের উত্তরেই বেরিয়ে আসে আত্মহত্যার নেপথ্য কারণ। অনুসন্ধান করলে দেখা যাবে, যারা আত্মহত্যা করছে তাদের মধ্যে ধর্মীয় শিক্ষার অভাব রয়েছে। একজন ধার্মিক মানুষ সর্বক্ষেত্রে পরকালীন জীবনকে সব কিছুর ওপর প্রাধান্য দেয়। সে পার্থিব জীবনকে তুচ্ছজ্ঞান করতে শেখে। সে উপলব্ধি করতে শেখে, মানব সৃষ্টি কেবল আল্লাহ তায়ালার সন্তুষ্টির জন্য এবং ইহ-জাগতিক সব বিষয়-আসয় হলো গৌণ। ধর্ম মানুষকে দুনিয়ার অসারতা অনুধাবন করতে শেখায়। সুতরাং পার্থিব কোনো জটিলতায় কিংবা সঙ্কটে ধার্মিক ব্যক্তি পরকালীন জীবনের ভাবনায় সান্ত্বনা খুঁজে পায় এবং স্বাভাবিক জীবনযাপনে উদ্বুদ্ধ হয়। পক্ষান্তরে যার অন্তরে জড়বাদি চিন্তা জেঁকে বসেছে কিংবা স্রষ্টায় অনাস্থা যাকে পেয়ে বসেছে; সে জীবনের যেকোনো পদস্খলনে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়ে এবং মারাত্মকভাবে অবসন্ন হয়ে পড়ে। এতে অনেকেই তার শুদ্ধ চিন্তাশক্তিটুকুও হারিয়ে ফেলে এবং সর্বশেষ ফয়সালা হিসেবে সে আত্মহত্যার মতো ভয়ঙ্কর ও গর্হিত কাজটাকে বেছে নেয়। পরকালীন অনন্ত জীবনের পরিণাম সম্পর্কে ভাবার সুযোগ আর তার হয়ে ওঠে না।
আত্মহত্যার প্রবণতা থেকে উত্তরণের অন্যতম উপায় হলো, জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে বিশ্ব নিয়ন্তা আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের নির্দেশিত পথ ইসলামের অনুসরণ। সফলতা ও ব্যর্থতার মাপকাঠি ইসলামকেই মানতে হবে। যখন কোনো মানুষ জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে আল্লাহ তায়ালার নির্দেশিত পথে চলতে ব্রতী হবে তখন পার্থিব কোনো জটিলতা কিংবা সঙ্কট চরম বিষণ্ণতায় রূপ নিয়ে তার নিকট প্রকাশিত হবে না। বরং সব ক্ষেত্রে নিজেকে ধৈর্য ধারণের শক্তি পাবেন তিনি। তাই আসুন নিজে ধর্মীয় অনুশাসন মেনে চলার পাশাপাশি অন্যকেও আহ্বান জানাই প্রকৃতির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ এই শাশ্বত সত্যের ধর্মে। আহ্বান জানাই পার্থিব সব কিছুর ওপর পরকালীন ভাবনাকে স্থান দিতে। আপনার-আমার প্রচেষ্টাতে হয়তো এমন কিছু মানুষ ফিরে আসবে যারা জীবনের প্রতি বীতশ্রদ্ধ হয়ে পড়েছিল। আর তাদের এই ফিরে আসা হবে আমাদের জন্য পরম সৌভাগ্যের ব্যাপার। আল্লাহ সবাইকে তওফিক দান করুন।