নারী মানেই পুরুষের দাসত্ব, নারী মানেই বোঝা- এ ধারণাকে অনেক আগেই বদলে দিয়েছেন নারীরা। নিজেদের উন্নয়নে ঘরে-বাইরে সমানতালে কাজ করছেন তারা। ঘরের পাশাপাশি বাইরের দুনিয়াকেও দুই হাতে সামলাচ্ছেন নারীরা।
কর্মক্ষেত্রে পুরুষের চেয়ে কোনো অংশেই তারা পিছিয়ে নেই। রাজনীতি, সামাজিক, অর্থনীতি সব জায়গাতেই দুর্বার গতিতে এগিয়ে যাচ্ছেন নারীরা। নিজেরাই আদায় করে নিচ্ছেন নিজেদের অধিকার। আজ ৮ মার্চ আন্তর্জাতিক নারী দিবস। প্রতিবছরের মতো নানা কর্মসূচির মাধ্যমে বাংলাদেশেও দিবসটি পালিত হচ্ছে। নারী দিবসে এবারের প্রতিপাদ্য ‘নারীর সুস্বাস্থ্য ও জাগরণ’।
৮ মার্চ যুক্তরাষ্ট্রে ঘটে যাওয়া এক আন্দোলনই নারী দিবস পালনের পটভূমি সৃষ্টি করে। ১৮৫৭ সালের ৮ মার্চ নিউইয়র্কের সুতা কারখানায় কর্মরত নারী শ্রমিকরা আন্দোলনে নামতে বাধ্য হন। সেদিন বেতন বৈষম্য, নির্দিষ্ট কর্মঘণ্টা আর কাজের বৈরী পরিবেশের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাতে নারীরা একজোট হলে তাদের ওপর কারখানা মালিকরা এবং তাদের মদদপুষ্ট প্রশাসন দমনপীড়ন চালায়। প্রায় অর্ধশতাব্দী পর ১৯০৮ সালে জার্মানিতে এ দিনটি স্মরণে প্রথম নারী সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। ১৯১০ সালে ডেনমার্কের কোপেন হেগেনে অনুষ্ঠিত হয় দ্বিতীয় আন্তর্জাতিক নারী সম্মেলন। ১৭টি দেশ থেকে প্রায় ১০০ নারী প্রতিনিধি এতে অংশ নিয়েছিলেন। ওই সম্মেলনেই প্রথমবারের মতো প্রতিবছরের ৮ মার্চকে আন্তর্জাতিক নারী দিবস হিসেবে পালন করার প্রস্তাব দেওয়া হয়।
এ প্রস্তাবে সাড়া দিয়ে ১৯১৪ সাল থেকে বেশ কয়েকটি দেশে ৮ মার্চ নারী দিবস পালিত হয়। বাংলাদেশে ১৯৭১ সাল থেকেই ৮ মার্চ আন্তর্জাতিক নারী দিবস হিসেবে পালিত হয়ে আসছে। ১৯৭৫ সালে জাতিসংঘ ৮ মার্চ দিনটিকে আন্তর্জাতিক নারী দিবস হিসেবে পালনের আহ্বান করলে এরপর থেকে বিশ্বব্যাপী দিবসটি পালিত হয়ে আসছে। নারী-পুরুষের বৈষম্য দূর করে সমানতালে এগিয়ে যাচ্ছেন নারীরা। অবদান রাখছেন চাকরি ও ব্যবসায়। প্রযুক্তির বিকাশের ফলে অনেকেই অনলাইনে ব্যবসা শুরু করেছেন। চাকরি ছেড়ে হয়েছেন উদ্যোক্তা।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) ‘হোলসেল অ্যান্ড রিটেইল ট্রেড সার্ভে অনুযায়ী ২০১৯-২০ অর্থবছরে দেশে নিবন্ধিত খুচরা ও পাইকারি প্রতিষ্ঠান ছিল ২৫ লাখ ৪০ হাজার ৮৯৭টি। এসব প্রতিষ্ঠানে পুরুষ উদ্যোক্তা ছিলেন ১ কোটি ৩৯ লাখ ১ হাজার ৫৬৪ জন। আর নারী উদ্যোক্তার সংখ্যা ২ লাখ ৩ হাজার ১৮৯। তবে পুরুষের তুলনায় কম হলেও নারী উদ্যোক্তার সংখ্যা এক দশকে ১২৬ শতাংশ বেড়েছে। ২০০৯-১০ অর্থবছরে নারী উদ্যোক্তা ছিলেন ৮৯ হাজার ৮৪৮ জন। এ সংখ্যা ২০০২-০৩ অর্থবছরে ছিল মাত্র ২১ হাজার ৮৬৭। অর্থাৎ দেড় দশকে নারী উদ্যোক্তা বেড়েছে ৮২৯ শতাংশ।
সাভারের বিউটি রানী সাহা একজন উদ্যোক্তা। ২০০৯ সালে সাভার সিটি সেন্টারে তিনি ব্যবসা (নারীদের পণ্য) শুরু করেন। এক দশক পর তার এখন দুটি দোকান। সে সঙ্গে বেড়েছে পুঁজিও। সময়ের আলোকে তিনি বলেন, ২০০৯ সালে প্রথম যখন ব্যবসা শুরু করি তখন বেশ চ্যালেঞ্জ ছিল। হাতে কোনো টাকা ছিল না। এরপর বাবা ও হাজবেন্ডের কাছ থেকে ৩ লাখ টাকা নিয়ে ব্যবসা শুরু করি। শুরুতে বিক্রি খুব ভালো না হলেও হাল ছাড়িনি। এরপর ধীরে ধীরে বিক্রি বাড়তে থাকে। ৩ লাখের পুঁজি এখন ২০ লাখ। মার্কেটে এখন আমার দুটি দোকান। সেখানে চারজন কর্মচারী কাজ করে। একই সঙ্গে অনলাইন প্লাটফর্মেও ব্যবসা শুরু করেছি। সেখানেও বেশ সাড়া পাচ্ছি। আমার পরিবার থেকে সবসময়ই সাপোর্ট পেয়েছি। পরিবার ও ব্যবসা দুটোই একসঙ্গে সামলেছি, কখনও সমস্যা হয়নি। প্রত্যেকটি মেয়েরই উচিত ঘরে বসে না থেকে কিছু না কিছু করা।
শুধু উদ্যোক্তাই নয় সরকারি-বেসরকারি চাকরিতেও নারীর অংশগ্রহণ বেড়েছে। বিভিন্ন প্রশিক্ষণের মাধ্যমে নারীদের স্বাবলম্বী করে তুলছে সরকার। তথ্যপ্রযুক্তি বিভাগের ‘লার্নিং ও আর্নিং ডেভেলপমেন্ট’ প্রকল্পের আওতায় ৫৩ হাজার প্রশিক্ষণার্থীকে দক্ষ ফ্রিল্যান্সার হিসেবে গড়ে তুলতে প্রশিক্ষণ প্রদান করা হয়। যার মধ্যে ৩০ শতাংশের বেশি শিক্ষিত নারী।
এ ছাড়া ৬টি ডিজিটাল ক্যারাভ্যান ট্রেনিং বাসের মাধ্যমে সারা দেশে প্রত্যন্ত অঞ্চলের ৫৭ হাজার ৬৮৩ জন শিক্ষিত বেকার নারীকে আইটি প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে অনেকেই ফ্রিল্যান্সিংয়ের মাধ্যমে ঘরে বসে আয় করছেন।
মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব (পরিকল্পনা ও পরিসংখ্যান অধিশাখা) নার্গিস খানম সময়ের আলোকে বলেন, নারীদের উন্নয়নে সরকার বেশ কিছু উদ্যোগ হাতে নিয়েছে। মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের ২২টি প্রকল্পের মধ্যে ২০টিই নারীদের উন্নয়নে নেওয়া হয়েছে।