অপার সৌন্দর্যময় এই নিখিলবিশ্বের রাজাধিরাজ মহান আল্লাহতায়ালা। পৃথিবীর স্থায়িত্ব টিকিয়ে রাখতে এবং প্রকৃতি ও পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষার্থে তিনি যেসব মাধ্যম সৃষ্টি করেছেন, সেসব মাধ্যমের অন্যতম মাধ্যম হচ্ছে বন। বৈচিত্র্যময় এই পৃথিবীতে রয়েছে ছোট-বড় অসংখ্য বন। এই যেমেন ব্রাজিলে রয়েছে পৃথিবীর সর্ববৃহৎ বন আমাজন। রহস্যময় বন রয়েছে আফ্রিকার দেশে দেশে। তেমনি পৃথিবীর বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ বন সুন্দরবন রয়েছে আমাদের এই বাংলাদেশে।
এটা আমাদের পরম সৌভাগ্য যে, সুন্দরবন পুরো পৃথিবীর মধ্যে অন্যতম। এখানে যেমন রয়েছে বিশ্ববিখ্যাত রয়েল বেঙ্গল টাইগার আর চিত্রল হরিণের অবাধ বিচরণ। তেমনি এর জলেও রয়েছে নানা মৎস্যসম্পদ। শুধু সম্পদই নয়, আমাদের এই সুন্দরবনে রয়েছে অপরিসীম নৈসর্গিক ও প্রাকৃতিক সৌন্দর্য। যার সৌন্দর্যে মুগ্ধ পুরো বিশ্ব। সেজন্যই ১৯৯৭ সালে ইউনেসকো সুন্দরবনকে ঘোষণা দেয় বিশ্ব ঐতিহ্য বলে। বন আর সমুদ্রের এমন মহামিলন খুঁজে পাওয়া যায় না পৃথিবীর অন্য কোথাও।
সুন্দরবন নামটাই বলে দেয় এর রূপ কেমন। বাংলায় সুন্দরবনের আক্ষরিক অর্থ সুন্দর জঙ্গল বা সুন্দর বনভূমি। তবে অধিকাংশ মানুষের ধারণা, সুন্দরীগাছ থেকেই এ বনের নামকরণ করা হয়েছে সুন্দরবন। বাংলাদেশ ও প্রতিবেশী দেশ ভারতের বিশাল অঞ্চল জুড়ে বিস্তৃত সমুদ্র অববাহিকার সম্মুখে অবস্থিত এই বনভূমির ৬২ শতাংশই বাংলাদেশের মধ্যে অবস্থিত। ১০ হাজার বর্গকিলোমিটার জুড়ে গড়ে ওঠা এই সুন্দরবনের ভৌগোলিক গঠন ব-দ্বীপীয়। যার উপরিতলে রয়েছে অসংখ্য জলধারা এবং জলতলে ছড়িয়ে আছে মাটির দেয়াল। এতে আরো রয়েছে তৃণভূমি, বালুতট ও দ্বীপ।
সুন্দরবনে জালের মতো ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে ছোট-বড় অনেক খাল ও নদী। এগুলোর নামও ভারী সুন্দর! যেমন হংসরাজ, রায়মঙ্গল, কটকা, ডুমুরিয়া, মরাবগী, ধানসাগর, সূর্যমুখী, পদ্মাবতী, আন্ধারমানিক, ঝনঝনিয়া, জয়মনি বলেশ্বর, পশুর, কলাগাছি, মালঞ্চ, নীলকমল ইত্যাদি। বিস্তৃত এই বনরাজ্যে আরও রয়েছে বিশ্বখ্যাত রয়েল বেঙ্গল টাইগারসহ মায়াবী হরিণ, ভয়ংকর ও সুন্দর অজগর, কুমির, বানরসহ প্রায় এক হাজার প্রজাতির পশু। সাড়ে তিনশ প্রজাতির পাখি। পাখি এ বনের অন্যতম প্রধান আকর্ষণ। এখানে এমন কিছু প্রজাতির পাখি আছে, যা বাংলাদেশের অন্য কোথাও দেখা যায় না। বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় পাখি মদনটাক বা হাড়গিলা এই বনেরই বাসিন্দা। প্রায় নয় প্রজাতির মাছরাঙা পাখির দেখা মেলে এই বনে। শীতকালে হিমালয় ও সাইবেরিয়া থেকে আসা অতিথি পাখির মিলনমেলা বসে এই সুন্দরবনে।
বিচিত্র সব বৈশিষ্ট্যের সমাহার ঘটেছে বনের বৃক্ষরাজিতে। যেমন বন রানীর আদরের ধন গাজী কালু, চম্পাবতী, মৌয়াল, বাওয়ালি, সুন্দরী, গরান, গেওয়া, কেওরা, ধুন্দল, গোলপাতাসহ মনজুড়ানো ৩৫০ প্রজাতির বৃক্ষ। বৃক্ষই হচ্ছে সুন্দরবনের প্রাণ। পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষার্থে বৃক্ষের বিকল্প নেই।
সেজন্যই ইসলামে বৃক্ষের প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরা হয়েছে গুরুত্বের সঙ্গে। পবিত্র কোরআনে আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘বলো তো কে সৃষ্টি করেছেন নভোমণ্ডল ও ভূমণ্ডল; এবং আকাশ থেকে তোমাদের জন্য বর্ষণ করেছেন পানি, অতঃপর তা দ্বারা আমি মনোরম বাগান সৃষ্টি করেছি।’ (সুরা নহল, আয়াত : ৬০)
অন্য আয়াতে বলা হয়েছে, ‘তিনি নানা প্রকারের লতাবিশিষ্ট ও কাণ্ডের ওপর দণ্ডায়মান বিশিষ্ট বাগান, খেজুরগাছ ও নানা প্রকার খাদ্যের উদ্ভিদ, ভেষজ, ফল-ফলাদি, জয়তুন ও আনারের গাছ সৃষ্টি করেছেন, যা বাহ্যিক রূপে সাদৃশ্যপূর্ণ কিন্তু স্বাদে সাদৃশ্যহীন।’ (সুরা আনআম, আয়াত : ১৪১)
সুস্বাদু ফল-ফলাদি, জ্বালানি ও গৃহসামগ্রী তৈরিতে বৃক্ষ তথা বনায়নের গুরুত্ব অপরিসীম। পরিবেশের ভারসাম্য বজায় রাখতে, জলবায়ু পরিবর্তনের চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করার অন্যতম হাতিয়ার বনায়ন। পরিবেশবিজ্ঞানের মতে, একটি দেশের পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষার্থে সে দেশের মোট ভূমির ২৫ শতাংশ বনভূমি থাকা অপরিহার্য। সেজন্যই মহানবী (সা.) বৃক্ষরোপণের জন্য সাহাবিদের উৎসাহিত করেছেন। তিনি বৃক্ষরোপণ ও ফসল বপনকে সদকায়ে জারিয়ার কাজ বলেছেন। হাদিসে বর্ণিত আছে, আনাস বিন মালিক (রা.) বলেন, রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘কোনো মুসলিম যদি বৃক্ষরোপণ করে কিংবা খাদ্যশস্যের বীজ বপন করে, অতঃপর তা থেকে কোনো মানুষ, পাখি অথবা পশু কিছু অংশ খায়, তবে তার জন্য এই কাজ (বীজ বপন) সদকা হিসেবে বিবেচিত হবে।’ (সহিহ বুখারি, খণ্ড : ৩, অধ্যায় : ৩৯, হাদিস : ৫১৩)
বৃক্ষ আমাদের সার্থকতার তালিম দেয়। বৃক্ষের পানে তাকিয়ে আমরা শিক্ষা নিতে পারি জীবনের তাৎপর্য কী। বৃক্ষ আছে বলেই সুন্দরবন বেঁচে আছে। গঙ্গার পলিমাটি ও মিষ্টি পানির সঙ্গে সমুদ্রের লবণাক্ত পানির সংযোগে কিছু বিশেষ বৃক্ষগুল্মের জন্ম হয়েছে এই বনে। আর এগুলোই সুন্দরবনের বিশেষত্ব। জাতীয় অর্থনীতিতেও সুন্দরবনের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। এটি দেশের বনজ সম্পদের একক বৃহত্তম উৎস।
সুন্দরবন কাঠের ওপর নির্ভরশীল শিল্পে কাঁচামাল জোগান দেয়। এ ছাড়া কাঠ, জ্বালানি ও ম-ের মতো প্রথাগত বনজ সম্পদের পাশাপাশি এ বন থেকে ব্যাপকভাবে আহরণ করা হয় ঘর ছাওয়ার পাতা, মধু, মৌচাকের মোম, মাছ, কাঁকড়া, শামুক ও ঝিনুক।
সুন্দরবন উপকূলবর্তী জনসংখ্যার জন্য উল্লেখযোগ্য পরিমাণে কর্মসংস্থান ও আয়ের সুযোগ সৃষ্টি করেছে। শুধু তা-ই নয়, উৎপাদনমুখী ভূমিকার পাশাপাশিও সুন্দরবন, ঘূর্ণিঝড়প্রবণ বাংলাদেশের উপকূলবর্তী জনসংখ্যা ও তাদের সম্পদের প্রাকৃতিক নিরাপত্তাবলয় হিসেবে ভূমিকা রাখে। সব মিলিয়ে এখানে যেন গড়ে উঠেছে আরেক পৃথিবী। যে পৃথিবীর সৌন্দর্য বর্ণনাতীত। সুন্দরবন আমাদের জন্য নেয়ামতের আধার। সুন্দরবন আমাদের গর্বের ধন। কিন্তু সম্প্রতি কিছু অসাধু মানুষের নানা রকম অপকর্মের কারণে বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ বন সুন্দরবন হারাতে বসেছে তার অপরূপ নৈসর্গিক সৌন্দর্য। সুন্দরবনকে ধ্বংস করার জন্য চলছে দেশি-বিদেশি চক্রান্ত। সরকারের কাছে আকুল আবেদন, পরিবেশ ও বিশ্ব ঐতিহ্য ও সুন্দরবনের সৌন্দর্য রক্ষার্থে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করুন।