দ্রুত বেড়ে যাওয়া করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ঠেকাতে আগামীকাল সোমবার থেকে এক সপ্তাহের জন্য কার্যত ‘লকডাউন’ ঘোষণা করা হচ্ছে। তবে লকডাউন শব্দবন্ধের পরিবর্তে কঠোর বিধিনিষেধ শব্দবন্ধ ব্যবহার করে প্রস্তাব দিয়েছে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ। আজ রবিবার এ সংক্রান্ত প্রজ্ঞাপন জারি করতে পারে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ। এ সময় জরুরি সেবা দেওয়া প্রতিষ্ঠান ছাড়া সব ধরনের সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকবে। তবে স্বাস্থ্যবিধি মেনে খোলা থাকবে শিল্পকারখানা। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের এবং জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী ফরহাদ হোসেন আলাদাভাবে গতকাল শনিবার সাংবাদিকদের এ কথা জানানোর সময় লকডাউন শব্দটি ব্যবহার করেন।
এর আগে করোনাভাইরাস সংক্রমণ পরিস্থিতিতে দীর্ঘ ৬৬ দিন বন্ধ থাকার পর গত বছর ৩১ মে থেকে শর্ত সাপেক্ষে খোলে সরকারি অফিস। গত বছরের ৮ মার্চ দেশে প্রথম করোনা রোগী শনাক্তের পর ২৬ মার্চ থেকে ৪ এপ্রিল প্রথম দফায় সাধারণ ছুটি ঘোষণা করে সরকার। এরপর দফায় দফায় সাধারণ ছুটি বাড়িয়ে ৩১ মার্চ পর্যন্ত বর্ধিত করা হয়।
কঠোর বিধিনিষেধ প্রজ্ঞাপন আকারে জারি করতে গতকাল বিকেলে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে বৈঠক করেন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা। মন্ত্রিপরিষদ সচিব খন্দকার আনোয়ারুল ইসলামের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত ভার্চুয়াল এ বৈঠকে মুখ্যসচিব, সংশ্লিষ্ট সিনিয়র সচিব, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর শীর্ষ কর্মকর্তা, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা যুক্ত ছিলেন। বৈঠকের পর কঠোর নিষেধাজ্ঞা আরোপের প্রস্তাব পাঠানো হয় প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে।
বৈঠকে কর্মকর্তারা শর্তসাপেক্ষে সার্বিক কার্যাবলি ও জনসাধারণের চলাচলে কঠোর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করার প্রস্তাব করেন। তাদের এ প্রস্তাব প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অনুমোদন করলে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ প্রজ্ঞাপন জারি করবে।
বৈঠক সূত্রে জানা গছে, নিষেধাজ্ঞার সময় এক জেলা হতে আরেক জেলায় জনসাধারণের চলাচল কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করার প্রস্তাব করা হয়েছে। প্রতিটি জেলার প্রবেশ ও বহির্গমন পথে চেকপোস্টের ব্যবস্থা থাকবে। জেলা প্রশাসন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সহায়তায় এ নিয়ন্ত্রণ সতর্কভাবে বাস্তবায়ন করবে। এ সময় জনগণকে অবশ্যই ঘরে অবস্থান করতে হবে। রাত ৮টা থেকে সকাল ৬টা পর্যন্ত অতি জরুরি প্রয়োজন ছাড়া কোনোভাবেই বাড়ির বাইরে বের হতে পারবে না। জরুরি প্রয়োজনের মধ্যে রয়েছে প্রয়োজনীয় কেনাবেচা, কর্মস্থলে যাতায়াত, ওষুধ ও নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্য কেনা, চিকিৎসা সেবা, মৃতদেহ দাফন ও সৎকার করা। এ সময় বাইরে বের হতে হলে অবশ্যই মাস্ক পরতে হবে। জনসাধারণ ও কর্তৃপক্ষকে স্বাস্থ্যসেবা বিভাগ থেকে জারিকৃত নির্দেশনা কঠোরভাবে মেনে চলতে হবে। হাটবাজার ও দোকানপাটে কেনাবেচার সময় পারস্পরিক দূরত্ব বজায় রাখতে হবে।
আইনশৃঙ্খলা, রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা ও গোয়েন্দা কাজে নিয়োজিত সংস্থা, জরুরি পরিষেবা, স্বাস্থ্যসেবা, বিদ্যুৎ, পানি, গ্যাস, জ¦ালানি, ফায়ার সার্ভিস, স্থল, নদী ও সমুদ্র বন্দরের কার্যক্রম, টেলিফোন, ইন্টারনেট, ডাকসেবাসহ অন্যান্য জরুরি ও অতাবশ্যকীয় পণ্য ও সেবার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট অফিস, তাদের কর্মচারী ও যানবাহন এ নিষেধাজ্ঞার আওতামুক্ত থাকবে।
সড়ক ও নৌপথে সব ধরনের পণ্য পরিবহনের কাজে নিয়োজিত ট্রাক, লরি, কার্গো ও ভেসেল চলাচল অব্যাহত থাকবে। কৃষিপণ্য সার, বীজ, কীটনাশক, খাদ্য, শিল্পপণ্য, রাষ্ট্রীয় প্রকল্পের মালামাল, কাঁচাবাজার, খাবার পরিবহন, ওষুধের দোকান, হাসপাতাল ও জরুরি সেবা এবং এসবের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কর্মীদের ক্ষেত্রে এ নিষেধাজ্ঞা প্রযোজ্য হবে না।
চিকিৎসা সেবায় নিয়োজিত চিকিৎসক, নার্স, কর্মী ও ওষুধ সরঞ্জামাদি বহনকারী যানবাহন ও এর কর্মী এ নিষেধাজ্ঞার আওতামুক্ত থাকবে। ইলেকট্রনিক ও প্রিন্ট মিডিয়া এবং কেব্ল টিভি নেটওয়ার্কে নিয়োজিত কর্মীরা এর বাইরে থাকবেন।
ওষুধ শিল্প, কৃষি উৎপাদন ও সরবরাহ ব্যবস্থার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ক্ষেত্রগুলো উৎপাদন ও রপ্তানিমুখী শিল্পসহ সব কলকারখানা কর্তৃপক্ষ শ্রমিকদের নিরাপত্তা ও স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করে চালু রাখতে পারবে। নিষেধাজ্ঞার সময় কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও কোচিং সেন্টার খোলা রাখা যাবে না। তবে অনলাইন কোর্স ডিসটেন্স লার্নিং অব্যাহত থাকবে। ব্যাংকিং ব্যবস্থা চালু রাখার জন্য বাংলাদেশ ব্যাংক প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দেবে।
মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে বৈঠকের আগে দিনভর আলোচনা চলে লকডাউন নিয়ে। সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের, জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী ফরহাদ হোসেন ছাড়াও রেলপথ মন্ত্রী নূরুল ইসলাম লকডাউনের কথা সাংবাদিকদের জানিয়েছেন।
জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী বলেন, ‘মানুষের চলাফেরা যাতে কমাতে পারি সেজন্য আমরা আপাতত এক সপ্তাহের জন্য লকডাউন দিচ্ছি। আমাদের জরুরি সেবা দেওয়া প্রতিষ্ঠান, ডিসি অফিস, ইউএনও অফিস, ফায়ার সার্ভিস অফিস, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অফিস, সংবাদপত্র অফিস এই ধরনের অফিস খোলা থাকবে। লকডাউনের মধ্যে শিল্পকারখানা খোলা থাকবে। একাধিক শিফট করে স্বাস্থ্যবিধি মেনে যাতে শ্রমিকরা কাজ করেন, সেটা নিশ্চিত করতে হবে। তা না হলে তো আবার গত বছরের মতো শ্রমিকদের বাড়ি যাওয়ার ঢল শুরু হয়ে যাবে। এছাড়া সরকারি ও বেসরকারি অফিস-আদালত বন্ধ থাকবে। সব ধরনের মার্কেট বন্ধ থাকবে।’
গণপরিবহন বন্ধ থাকবে কিনা জানতে চাইলে ফরহাদ হোসেন বলেন, ‘আমরা যখন এ বিষয়ে প্রজ্ঞাপন জারি করব সেখানে তা স্পষ্ট করে বলা হবে।’
প্রতিমন্ত্রী আরও বলেন, ‘মানুষের চলাচল যাতে একেবারে সীমিত করে ফেলা যায় আমরা সেই পদক্ষেপ নেব। কেউ অপ্রয়োজনে ঘর থেকে বের হতে পারবে না।’
অনেক লোক বিভিন্ন স্থানে গিয়ে আটকে থাকতে পারে, তাদের সেই সুযোগটা দিয়ে একদিন পর লকডাউন দেওয়া হচ্ছে বলেও জানান জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী।
করোনাভাইরাসের সংক্রমণ রোধে আপাতত সাত দিনের লকডাউন দেওয়া হলেও লকডাউনের শেষের দিকে গিয়ে বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে পরামর্শ করে পরবর্তী বিষয়ে বিবেচনা করা হবে বলে জানান তিনি।
এক সপ্তাহের জন্য লকডাউন কেন, জানতে চাইলে প্রতিমন্ত্রী বলেন, ‘আপাতত সাত দিন লকডাউন দিচ্ছি। আশা করছি, এই সাত দিন মানুষকে ঘরের মধ্যে রাখতে পারলে সংক্রমণ রোধ করতে পারব। তা না হলে সংক্রমণ আরও ছড়িয়ে যাবে। মানুষের নানা বিষয় আছে, সেগুলো সাত দিন লকডাউনের শেষের দিকে বিবেচনা করব, বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ নেব। আপাতত সাত দিন থাকবে।’
এর আগে লকডাউনে শ্রমজীবী মানুষদের জন্য বিভিন্ন রকমের সহায়তার ব্যবস্থা ছিল, এবার কী হবে? এমন প্রশ্নে প্রতিমন্ত্রী বলেন, ‘প্রজ্ঞাপন যখন দেওয়া হবে, তখন বিস্তারিত থাকবে।’
এর আগে প্রতিমন্ত্রী রাজধানীর বেইলি রোডের বাসা থেকে গণমাধ্যমে পাঠানো ভিডিও বার্তায় বলেন, লকডাউনে জরুরি সেবা দেওয়া হয় এমন প্রতিষ্ঠানগুলোই শুধু খোলা থাকবে। শিল্পকারখানাও খোলা থাকবে। শ্রমিকরা স্বাস্থ্যবিধি মেনে শিফট (পালা করে) অনুযায়ী কাজ করবেন।
এর আগে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের সাংবাদিকদের বলেছেন, আগামীকাল সোমবার থেকে সারা দেশে এক সপ্তাহের জন্য লকডাউন থাকবে।
রেলমন্ত্রী নূরুল ইসলাম লকডাউনে যাত্রীবাহী ট্রেন চলাচল বন্ধ থাকবে বলে সাংবাদিকদের জানিয়েছেন। এছাড়া বেসামরিক বিমান চলচল কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে অভ্যন্তরীণ রুটে বিমান চলাচল বন্ধ থাকবে।