অভিযোগ রয়েছে, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন উপহার দিতে ব্যর্থ হয়েছে বর্তমান কমিশন। বর্তমান কমিশনের বিরুদ্ধে সবচেয়ে বড় অভিযোগ হলো নির্বাচন ব্যবস্থাকে ধ্বংস করা।
২০১৭ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি দায়িত্ব নেওয়ার পর শুরুতেই আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে আসেন স্বয়ং প্রধান নির্বাচন কমিশনার কেএম নূরুল হুদা। বিভিন্ন মহলে প্রশ্ন ওঠে তার রাজনৈতিক পরিচয় নিয়ে। কুমিল্লার জেলা প্রশাসক থাকাকালে আওয়ামী লীগ-সমর্থিত ‘জনতার মঞ্চের’ সঙ্গে সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ তোলে বিএনপিসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দল। তারা বলেছেন, সিইসি সরকার ঘরানার লোক। তার কিছুটা আভাস মেলে জাতীয় নির্বাচনে। রাজনীতির সঙ্গে সেভাবে সম্পৃক্ততা না থাকলেও একাদশ সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের টিকেটে পটুয়াখালী-৩ আসন থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন সিইসির ভাগনে এসএম শাহজাদা। এরপর গত পাঁচ বছরে আর বিতর্ক পিছু ছাড়েনি।
বর্তমান কমিশনের উল্লেখযোগ্য কিছু নির্বাচন : দায়িত্ব গ্রহণের প্রথম অভিযোগ ওঠে ২০১৮ সালের ১৫ মে মাসে গাজীপুর ও খুলনা সিটি নির্বাচন নিয়ে। এরপর রাজশাহী, বরিশাল, গাজীপুর সিটি নির্বাচনও ছিল প্রশ্নবিদ্ধ। নির্বাচনে অনিয়মের অভিযোগ পেলেও কোনো ব্যবস্থা নেয়নি ইসি।
এরপর ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত একাদশ সংসদ নির্বাচনে ভোটের আগের রাতেই ক্ষমতাসীনরা ব্যালট বাক্স ভর্তি করে বলে অভিযোগ তোলে বিএনপিসহ সরকারবিরোধী দলগুলো। ভোটের কেন্দ্রভিত্তিক ফল ছিল অসঙ্গতিপূর্ণ। ১০৩টি আসনের ২১৩টি ভোটকেন্দ্রে শতভাগ ভোট পড়ে। এরপর ধীরে ধীরে ভোটারদের অনীহা বাড়তে থাকে। যার প্রভাব পড়ে ঢাকা সিটি করপোরেশন নির্বাচনে। ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারিতে ইভিএমে নেওয়া ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনে ভোট পড়েছিল মাত্র ২৫ দশমিক ৩০ শতাংশ এবং দক্ষিণে ২৯ শতাংশ। একই অবস্থা ছিল পরবর্তী পৌরসভা ও উপজেলা পরিষদের নির্বাচনগুলোতেও।
তবে শেষ সময়ে এসে ইউপি নির্বাচনে ভোটের হার বেড়ে যায়। একই সঙ্গে বাড়তে থাকে সহিংসতা ও প্রাণহানি। ইসির তথ্য অনুযায়ী চলমান ইউপি নির্বাচনে ভোট পড়েছে ৭৫ শতাংশ। বিপরীতে বিভিন্ন সংবাদপত্রে প্রকাশিত খবরের তথ্য অনুযায়ী ভোটের আগে ও পরে সব মিলিয়ে গত ৫ মাসে নির্বাচনি সহিংসতায় সারা দেশে শতাধিক মানুষ নিহত হয়েছেন। সর্বশেষ গত সোমবার সপ্তম ধাপের নির্বাচনে চট্টগ্রামের সাতকানিয়ায় কিশোরসহ দুজন নিহত হয়েছেন। সহিংসতা ছাড়াও ইউপি নির্বাচনে ভোট ছাড়া নির্বাচিতদের সংখ্যা বেড়ে যায়। ইউপি নির্বাচনের সপ্তম ধাপ পর্যন্ত বিভিন্ন পদে ১ হাজার ৬৭১ জন প্রার্থী বিনা ভোটে নির্বাচিত হয়েছেন। এর আগে ২০১৯ সালে উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় চেয়ারম্যান হন ১১১ জন। ফলে ভোট ব্যবস্থার ওপর আস্থাহীন হয়ে পড়েন ভোটাররা। ভোটে অনিয়ম ও কারচুপির শত শত অভিযোগ থাকলেও তেমন কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। তবে নির্বাচন কমিশনার রফিকুল ইসলামের দাবি, সবকিছুই আইন অনুযায়ী হয়েছে।
সময়ের আলোকে তিনি বলেন, গত পাঁচ বছরে যা করেছি সবকিছু আইন অনুযায়ী করেছি। আর আইন অনুযায়ী করার জন্যই আমরা শপথ নিয়েছি। এখানে সফলতা ও ব্যর্থতার কিছু নেই। সফলতা ও ব্যর্থতার মূল্যায়ন করবে অন্যরা। আমরা শুধু আমাদের দায়িত্ব পালন করে গেছি ভবিষ্যতে যারা আসবে তারা তাদের দায়িত্ব পালন করবে।
ইভিএম বিতর্ক : বর্তমান কমিশনের বিরুদ্ধে আরেকটি গুরুতর অভিযোগ হলো ভোটে ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন (ইভিএম) ব্যবহার। বিরোধী দলগুলো ইভিএমকে ভোট কারচুপির যন্ত্র বলে অভিযোগ করলেও ইভিএমেই অনড় ছিল ইসি।
তবে বিদায়ি কমিশনের সবচেয়ে বড় ব্যর্থতা ছিল বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর অনাস্থা। অনুষ্ঠিত বিভিন্ন নির্বাচন নিয়ে ইসি যখন সন্তোষ প্রকাশ করেছে, রাজনৈতিক দলগুলো তখন সেটাকে প্রত্যাখ্যান করেছে। বেশিরভাগ ভোট নিয়েই নানা মহলে প্রশ্ন উঠেছে। বিভিন্ন নির্বাচন নিয়ে যেসব অভিযোগ উঠেছিল সেগুলো উপেক্ষা করায় নির্বাচনের গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে উঠেছে প্রশ্ন। তবে এসব অভিযোগ মানতে নারাজ ইসি।
অনাস্থা প্রসঙ্গে নির্বাচন কমিশনার রফিকুল ইসলাম বলেন, কোনো দল যদি নির্বাচনে অংশগ্রহণ না করে আবার ওই দলটাই যদি প্রতীক ছাড়া অংশগ্রহণ করে তা হলে কমিশনের প্রতি অনাস্থা প্রমাণ হয় কী করে? তারাই তো প্রার্থীদের নির্বাচনে অংশগ্রহণ করার অনুমতি দিয়েছে। এ ইউপি নির্বাচনেও বিএনপির শত শত প্রার্থী জয়লাভ করেছে। তা হলে অংশগ্রহণ করল না কীভাবে?
বিতর্কহীন নির্বাচন : সব নির্বাচন নিয়ে বিতর্ক থাকলেও কিছু নির্বাচন ছিল বিতর্কের ঊর্ধ্বে যেমন ২০১৭ সালের মার্চে কুমিল্লা, ময়মনসিংহ সিটি করপোরেশন নির্বাচন করে প্রশংসিত হয়েছিল হুদা কমিশন। এরপর ডিসেম্বরে রংপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচনও ভালো হয়েছিল। সর্বশেষ নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন নির্বাচনও ছিল সুষ্ঠু ও বিতর্কমুক্ত। এর বাইরেও কিছু প্রশংসাযোগ্য কাজ করেছে ইসি। যেমন- অনলাইনে মনোনয়নপত্র দাখিল, স্মার্ট এনআইডি কার্ড ও মুক্তিযোদ্ধাদের এনআইডিতে বীর মুক্তিযোদ্ধা লেখা ইত্যাদি।