যে ছেলে বা মেয়েটি ক্লাসে বেশি মনোযোগী, নিয়মিত পড়াশুনা করে এবং বাড়িতে এসেও হোম ওয়ার্ক করতে ভুলে না সে সবার কাছে প্রিয় হয়ে বেড়ে উঠে। সে বছরের পর বছর পরীক্ষার ফলাফল ভালো করে। তাকে সবাই আদর করে এবং সম্মানের চোখে দেখে। এ ধরণের ছেলেমেয়েরা স্কুল-কলেজ এবং বিশ্ববিদ্যালয় অবধি সবার প্রিয় হয়ে থাকে। অন্যদিকে যে ছেলে বা মেয়েটি কোনোরকম টেনেটুনে পাস করে হয়তোবা বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত পৌঁছায় সে লাঞ্চনা-গঞ্জনার মধ্যে দিয়েই কিন্তু তার ছাত্রজীবন শেষ করে। এরা একই সমাজের দুটো ভিন্ন ধরণের অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে বেড়ে উঠে। সমাজের পাঠশালা বলতে পুঁথিগত বিদ্যাকেই বোঝানো হয়। সেক্ষেত্রে এই অভাগা অবহেলিত ছাত্র বা ছাত্রীটির মধ্যে পুঁথিগত মেধা ছাড়া অন্য কোনো গুণ থাকলেও তা প্রকাশ করার মতো হিম্মত তার হয়ে উঠে না সমাজ এমন কি বাবা-মা বা বন্ধু-বান্ধবীর কাছে। কোনো এক সময় হয়তোবা সেই পুঁথিগত বিদ্যাধারী মস্ত বড় ডাক্তার বা ইঞ্জিনিয়ার হয়, অন্যদিকে সেই অবহেলিত শিক্ষার্থী সমাজের ছোটখাটো কাজে যোগদান করে। যখন কিছুই করার থাকে না তখন রাজনীতি করে। এরা কখনও সমাজের চোখে ভালো অ্যাসেট হয়ে স্বীকৃতি পায় না। এরা শুরু থেকেই জানে যে এদের কাজকর্মে কখনও তারা প্রত্যাশিত ফিডব্যাক পাবে না। সেক্ষেত্রে এদের মধ্যে গড়ে উঠে ‘হারাবার কিছুই নেই’ ধরনের মনোভাব এবং ভাবতে শেখে, যা কিছুই করিনা কেন সবটাই বেটার দ্যান নাথিং। স্কুল কলেজে পিছনের বেঞ্চে বসা সেই শিক্ষার্থী দেখা যায় মন্ত্রী, ইন্ডাস্ট্রি বা ক্লিনিকের মালিক হয়ে শেষে সেই খ্যাতনামা ডাক্তার ইঞ্জিনিয়ারদের হায়ার করে মোটা অংকের টাকা এবং অন্যান্য সুযোগ সুবিধা দিয়ে। ঐ ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়াররা টাকার কাছে বিক্রি হয়ে যায়। দেখা গেলো একটি মর্ডান ক্লিনিকের মালিক ডাক্তারকে ডেকে বলে দিলো, শুনুন ডাক্তার বাবু, আমার এখানে কাজ করছেন ভালো বেতনে। এখন যদি বেতনের টাকাটা না তুলে আনতে পারেন তাহলে তো আপনাকে চাকরিতে রাখা সম্ভব হবে না। ডাক্তার হয়ত বললো তাহলে আমাকে কী করতে হবে? কী করতে হবে মানে বুঝতে পারছেন না? তাহলে শুনুন গত মাসে তিরিশটি ডেলিভারির রোগী এসেছে। তাদেরকে নরমাল ডেলিভারি না করে যদি সিজার করতেন তাহলে আমার ক্লিনিকের যে সমস্ত ইকুইপমেন্ট রয়েছে সেগুলোর সঠিক ব্যবহার হোত, নার্স থেকে শুরু করে সবাই ফুল টাইম কাজ পেতো। আমার যে ইনভেস্ট তা উঠে আসতো সাথে আপনার বেতনসহ কিছু একস্ট্রা সুবিধা পেতেন। ডাক্তারের বিষয়টি না বোঝার কোনো কারণ থাকার কথা নয়। সারাজীবন পুঁথিগত বিদ্যার সঙ্গে যাদের উঠাবসা তারা জানে দুই প্লাস দুই চার হয়। অতএব মালিককে খুশি করতে চিকিৎসা ব্যবস্থায় এখন শুরু হয়ে গেলো কসাইখানা। এমতাবস্থায় রোগীর সাথে ডাক্তারের সম্পর্কটা কখনও মনঃপূত হতে পারে কি? মালিক গড়ছে টাকার প্রাসাদ, রোগী গড়ছে ঘৃণার প্রাসাদ আর ডাক্তার গড়ছে সুচিন্তাহীন নতুন জীবন। প্রতিনিয়ত ভাবছে কেন পুলিশ অফিসার বা বিসিএস ক্যাডার হলাম না? কী করলাম লেখাপড়া করে? কী লাভ হোল সারাজীবন ভালো ছাত্র হয়ে ইত্যাদি। এতক্ষণ যা বর্ণনা করলাম এটা বাংলাদেশের ডাক্তারদের বর্তমান অবস্থা। এখন দেখা যাক কেমন চলছে সুইডেনে। এখানেও একই ব্যাপার প্রশিক্ষণের ক্ষেত্রে। ভালো শিক্ষার্থী হতে হয় ডাক্তার হতে হলে। বেশ পরিমাণ স্টাডি লোন নিয়ে পুরো প্রশিক্ষণ শেষ করতে হয়, তারপর চাকরি জীবন। শুরু থেকেই ভালো বেতন, ভালো সুযোগ সুবিধা। ডাক্তার রুগীর চিকিৎসা করে, কখনও ভাবে না মালিক কী ভাবছে বা বলছে। মালিকের কখনও এমন সাহস হবে না ডাক্তারকে বলার যে একজন নরমাল ডেলিভারি রুগীর পেটে ছুরি ঢুকাও। কী কারণ রয়েছে তাহলে বাংলাদেশ এবং সুইডেনের ভিন্ন ধরণের নিয়ম কানুনের পেছনে? কে এর জন্য দায়ী? সমাজ, রাষ্ট্র, দরিদ্রতা, দুর্নীতি, মরাল ভ্যালুর অবক্ষয়, সিস্টেমের অভাব, নাকি সব কিছুর সমন্বয়? মাটির পৃথিবী তুমিই বল আমরা তো দেখতে অবিকল একরকম তা সত্ত্বেও কেন অত বড় ব্যবধান? সব প্রশ্নের উত্তর জানা নেই তবে এতটুকু বলতে পারি তা হোল নাগরিকের জন্মের শুরুতে কে ক্লাসে পড়াশোনায় ভালো আর কে খারাপ এটা বিচার না করে সুইডিশ জাতি প্রত্যেকেই তার নিজ নিজ জায়গা থেকে ব্যক্তির নিজের চিন্তা চেতনার উপর গুরুত্ব দেয়। তাছাড়া সেইভাবে তাকে সম্মানের সঙ্গে গড়ে উঠতে সাহায্য করে। যার ফলে পরস্পরের মধ্যে ভেদাভেদের পার্থক্যটি বাংলাদেশের মতো হয় না। সমাজে প্রত্যেকটি কাজের গুরুত্ব অপরিসীম। মিউচ্যুয়াল আন্ডারস্ট্যান্ডিং ইজ মাস্ট যার কারণে ছোট বেলায় কেউ অবহেলিত হয়ে গড়ে উঠেনা যা বাংলাদেশে এখনও চলছে। যেকারণে অবহেলিত নাগরিকরা নিজের অস্তিত্বকে মজবুত করতে অনৈতিক কাজ করতে দ্বিধাবোধ করে না। কারণ ছোটবেলা থেকে লাঞ্চিত আর বঞ্চিত জীবনে বিবেক কী তা তো তাদের জীবনের অভিধানে কখনও ছিলো না। থাকতো যদি পরিবার, সমাজ এবং রাষ্ট্র সুইডেনের মতো করে শুরু থেকে তাদেরকেও অবহেলা বা ভেদাভেদ না সৃষ্টি করে বরং একই ভাবে বেড়ে উঠতে সাহায্য করতো।