শপিংমল, সরকারি-বেসরকারি অফিস-আদালত ও বাণিজ্য মেলাসহ সব কিছু খোলা রয়েছে। এমন অবস্থায় করোনাভাইরাস ওমিক্রনের সংক্রমণ বেড়ে যাওয়ায় সরকার অর্ধেক যাত্রী নিয়ে গণপরিবহন চালানোর নির্দেশ দিয়েছে। বাসমালিকরা বলছেন, শতভাগ যাত্রী নিয়েই তারা চলতে চান। একই সঙ্গে তারা সরকারের দেওয়া শর্ত প্রত্যাহারের অনুরোধ করেছেন। এমন প্রেক্ষাপটে স্বাস্থ্যবিধি কার্যকর করা সম্ভব হবে কি না- এ প্রশ্ন উঠেছে।
এক্ষেত্রে যাত্রী, চালক, কন্ডাক্টর ও সুপারভাইজরদের পক্ষে কি স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা সম্ভব হবে? বরং পরিবহনে যাত্রী কম নিলে অতিরিক্ত যাত্রীরা বিকল্প উপায় খুঁজবে, যা হবে আরও অস্বাস্থ্যসম্মত।
এর আগে ২০২০ ও ২০২১ সালে যথাযথভাবে পরিবহনে স্বাস্থ্যবিধি মানা হয়নি। ওই দুবছর অর্ধেক যাত্রী নেওয়ার শর্তে ৬০ শতাংশ ভাড়া বাড়ানো হয়েছিল। কিন্তু দেখা গেছে কিছু বাস সেটা মানলেও বেশিরভাগ বাসে সেই শর্ত মানা হয়নি। কিন্তু ভাড়া আদায় করা হয়েছিল বর্ধিত নিয়মেই। অন্যদিকে যাত্রী নেওয়া হয়েছে সব আসনেই। অনেক ক্ষেত্রে দাঁড়িয়েও যাত্রী নেওয়া হয়েছে। সরকারের ঘোষণা বৃহস্পতিবার থেকে অর্ধেক যাত্রী নিয়ে বাস, ট্রেন ও লঞ্চ চালাতে হবে।
এ বিষয়ে বুধবার দুপুরে মালিক, শ্রমিক, ভোক্তা অধিদফতর, পুলিশ ও সংশ্লিষ্টদের নিয়ে বৈঠকে বসে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ)। বৈঠক শেষে বিআরটিএ’র চেয়ারম্যান নুর মোহাম্মদ মজুমদার জানান, বাসভাড়া এবার বাড়ছে না। ১৩ তারিখের পরিবর্তে আগামী ১৫ জানুয়ারি থেকে স্বাস্থ্যবিধি মেনে পরিবহন চলবে। সেক্ষেত্রে শ্রমিক, যাত্রীদের শতভাগ মাস্ক পরিধান করতে হবে। ট্রিপের শুরু ও শেষে স্যানিটাইজ ব্যবস্থা মানতে হবে।
একইভাবে কাউন্টারসহ শ্রমিকরা যেখানে কাজ করে, সেখানে কঠোরভাবে স্বাস্থ্যবিধি মানতে হবে। সব কিছু যেহেতু খোলা, তাই অর্ধেক যাত্রী নিয়ে চললে পরিবহনের সঙ্কট দেখা দেবে। যাত্রীদের ভোগান্তি হবে। তাই মালিক সমিতির নেতারা বলেছেন শর্তটা শিথিল করার জন্য এবং তা যেন আমরা সরকারকে দ্রুত জানিয়ে দেই। শতভাগ শ্রমিক করোনা ভ্যাকসিনের আওতায় নেই। সেক্ষেত্রে অবিলম্বে ক্র্যাশ প্রোগ্রামের মতো করে তাদের ভ্যাকসিনের আওতায় আনার সুযোগ দিতে হবে, যা সরকারকে আমরা জানিয়ে দেব।
সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘অর্ধেক যাত্রী নিয়ে বাস চালানোর সিদ্ধান্ত তো আছেই। তবে আমরা মালিক-শ্রমিকদের দাবির বিষয়ে সরকারকে জানাব। এর মধ্যে (১৫ তারিখের আগে) একটা নির্দেশনা পাব। এখন পর্যন্ত কেবিনেটের (মন্ত্রিপরিষদের) সিদ্ধান্ত অনুযায়ী অর্ধেক আসন ফাঁকা রেখে বর্তমান ভাড়াতেই বাস চলবে, যা শনিবার থেকে কার্যকর হবে। তবে কেবিনেটের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী এবং মালিকদের দাবি অনুযায়ী যত আসন তত যাত্রী নেওয়া যায় কি না, তা সরকারকে আমরা জানাব।’ তবে তার কথা অনুযায়ী আগামী শনিবারের আগেই সরকারের পক্ষ থেকে সব আসনে যাত্রী পরিবহনের সিদ্ধান্ত আসবে বলে ইঙ্গিত পাওয়া যায়।
একই সঙ্গে সব আসনে যাত্রী পরিবহনের সুযোগ না দিলে মালিকদের পক্ষে গণপরিবহন বন্ধ করে দেওয়ারও কিছুটা হুমকি পাওয়া গেল। ওই একই বৈঠকে উপস্থিত বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির সভাপতি ও জাতীয় পার্টির সংসদ সদস্য মসিউর রহমান রাঙ্গা বলেন, ‘আমরা আপিল করেছি, প্রধানমন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণ করেছি। ওনি যদি এটা করেন (সব আসনে যাত্রী নেওয়া) তা হলে ভালো। আর না করলে, শ্রমিকদের টিকার ব্যবস্থা যদি শতভাগ হয় তা হলে বাস চলবে, না হলে সরকার তাদের বাস চালাতে দেবে না।’
তিনি আরও বলেন, ‘সরকারের কাছে আমাদের অনুরোধ, আমরা সব আসনেই যাত্রী নিয়ে চলতে চাই। টার্মিনালে ভ্যাকসিনের ব্যবস্থা করা যায় কি না বা লাইসেন্স নিয়ে গেলেই যেন ভ্যাকসিন দেওয়া যায়- যা সে ব্যবস্থা চাই। সব আসনেই যাত্রী থাকুক এবং তাদের একশভাগ নিরাপত্তার ব্যবস্থা করা হবে। বিমানে দেখবেন অনেক কাছাকাছি বসা হয়, তাতে সংক্রমণ হয়নি। আমাদের পরিবহনেও সংক্রমণ হবে না। আমরা কোনোভাবেই ভাড়া বৃদ্ধি করতে চাই না, স্বাভাবিক অবস্থা বজায় রাখতে চাই। সব অফিস, শপিংমল খোলা, চলছে বাণিজ্য মেলা। এমন সবকিছু চালু রেখে শুধু গণপরিবহনে স্বাস্থ্যবিধি মানা যাবে না বলে মনে করেন জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, পরিবহনে স্বাস্থ্যবিধি মানাতে রাস্তায় যেন কম মানুষ নামে সে ব্যবস্থা করতে হবে। তা ছাড়া স্বাস্থ্যবিধি মানা সম্ভব হবে না।
এ বিষয়ে হেলথ অ্যান্ড হোপ হাসপাতালের চেয়ারম্যান ও জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. লেলিন চৌধুরী সময়ের আলোকে বলেন, ‘দেশে বাস্তবায়নযোগ্য সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিত। যখন সারা দেশে চলাচলযোগ্য মানুষের সংখ্যা একই থাকবে, কিন্তু যানবাহনের আসন সংখ্যা অর্ধেক হয়ে যাবে, তখন কি দাঁড়াবে? এটা মেইনটেন্ট করা সম্ভব হবে না। এক্ষেত্রে মানুষ বিকল্প ব্যবস্থা বের করবে। তা আরও বেশি অস্বাস্থ্যকর হবে।গণপরিবহনে যেভাবে আসন বিন্যাস করা আছে, সেভাবেও স্বাস্থ্যবিধি মানা সম্ভব নয়। এক্ষেত্রে যাত্রী সংখ্যা কমানোর উদ্যোগ নিতে হবে। যেমন দিল্লিতে নেওয়া হয়েছে। সেটা হলো যাদের বাসায় থেকে কাজ করার সুযোগ আছে, তাদের বাসায় থাকতে হবে। এতে একটা অংশ কিন্তু কমে গেল। পরিকল্পনাটা হতে হবে পথে মানুষজনের সংখ্যা কমাতে হবে। এই জায়গায় কাজ না করে শুধু গণপরিবহন কমাতে চাইলে তো হবে না।’