(উপমহাদেশের প্রখ্যাত আধ্যাত্মিক সাধক পীরে পাগলা হযরত শাহ সৈয়দ আমির উদ্দিন (রঃ) পাগলা মিয়ার ফেনী ভূমিতে যুগ যুগ ধরে প্রচুর পাগল, ফকির, অলি, আউলিয়া ও দরবেশের আনাগোনা লক্ষ করা যায়। নাম জানা অজানা প্রচুর পাগল ফেনীতে প্রতিনিয়ত বিচরণ করে থাকে। অতীতে যেমন ফেনীতে পাগল ছিল, বর্তমানেও অনেক পাগল রয়েছে। কোন পাগলের কাছে কি আছে, কে আল্লাহর অলি কিংবা কে ভন্ড প্রতারক ও কে মানসিক রোগি তা কেউ সঠিক ভাবে বলতে পারে না। পাগলা মিয়ার ফেনী ভূমিতে পাগলদের আনাগোনা ফেনীর মানুষ সম্মানের চোখে দেখে থাকে। ফলে এখানকার মানুষেরা পাগলদের যত্ন-আত্মি করতে ভুলে না।
১৯৮০ দশকে ফেনীতে আলোচিত পাগল বা স্থানীয়দের ভাষায় মামা বলে ব্যাপক পরিচিত ছিলেন, ফুলগাজীতে মোহাম্মদ আলী দরবেশ, পরশুরাম চিতলিয়ার সাদা মামা, সোনাগাজীর আবুল মামা, মিরসরাইয়ের মাস্টার মামা, সিলেটের কুতুব উদ্দিন মামা, কালু মামা, লাতু মামা ছিলেন উল্লেখযোগ্য।
এসব পাগল দরবেশ, ফকির বা মামাদের কিছু কেরামতি বা অলৌকিক ঘটনা রয়েছে। যা স্থানীয়দের মুখে মুখে এখনো উচ্চারিত হয়। এসব ঘটনার প্রচুর প্রত্যক্ষদর্শী রয়েছে। কিন্তু ঘটনা গুলো কোনো লেখায় কিংবা বইয়ে সংকলিত না হওয়ায় তা হারিয়ে যেতে বসেছে। বক্ষমান লেখায় ফেনীর এসব পাগল ফকিরদের অলৌকিক বা কাকতালীয় ঘটনা গুলো সংকলিত করার নিমিত্তে তুলে ধরা হলো।
এসব পাগল ফকির ও মামাদের কিছু কিছু অস্বাভাবিক ঘটনা রয়েছে, যা সাধারণ মানুষ শ্রদ্ধা ও সম্মানের চোখে দেখে থাকে। এসব পাগল ফকিরদের ফেনীর মানুষ কখনো ঘাটাতে চায়নি, অভিশাপ ও বদদোয়ার ভয়ে। আবার ফেনীর অনেক ধনাঢ্য ব্যক্তি এসব পাগলদের বিশেষভাবে সম্মান করতে দেখা যেতো। শুধু তাই নয়, তাদের থাকা খাওয়ারও ব্যবস্থা করতো।
যেমন, চেওরিয়া হাউজের ছুট্টু মিয়া, গেদু মিয়া, কোব্বাদ আহমেদ প্রণিধানযোগ্য। এখানে কয়েকজন পাগল-ফকির, দরবেশ বা মামাকে নিয়ে সাম্যক আলোকপাত করা হলো।)
সাদা মামা
হযরত শাহ সূফি খান বাহাদূর আবদুর রহমান প্রকাশ সাদা মামা ছিলেন, পরশুরাম উপজেলার ধনিকুন্ডা গ্রামের মরহুম জান বক্স ও জয়নব বিবির সন্তান। তিন ভাই, দু’বোনের মধ্যে ভাইদের থেকে ছোট ছিলেন সাদা মামা।
১৯০২/৩ সালে সাদা মামা জন্ম গ্রহন করেন। ১৯৯৩ সালের, ৮ ফেব্রুয়ারী তিনি মৃত্যুবরণ করেন।
ফেনী মহকুমা আওয়ামীলীগের তৎকালীন সাধারন সম্পাদক শামসুল হক খদ্দর সাদা মামার বাল্যবন্ধু ছিলেন। আমার রাজনৈতিক জীবনের কতকথা আত্মজীবনী মূলক বইতে শামসুল হক খদ্দর সাদা মামা সম্পর্কে বলেন, সাদা মামার ছোটবেলা থেকেই বায়ু ছড়া ছিলো। ফলে অল্প বয়সেই তার চুল সাদা হতে থাকে। তিনি ফর্সা ছিলেন, সাদা রং তিনি পছন্দ করতেন। সাদা শার্ট প্যান্ট পরতে ভালবাসতেন। উদ্ভট আচরণ ও অসংলগ্ন কথা বলতেন। এজন্য সমবয়সীরা তাকে সাদা মামা বলে ডাকতেন। সাদা মামা নামটি এতো বেশী প্রচার পেয়েছিলো যে, তার প্রকৃত নামটা আড়াল হয়ে সাদা নামেই ব্যাপক পরিচিতি পান। ধনীকুন্ডা সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে ১৯১৪ সালে আমি ও সাদা মামা পাশ করে ফুলগাজী পাইলট হাই স্কুলে ভর্তি হই। এরপর শুরু হয় প্রথম বিশ্বযুদ্ধ।
সে সময় আমরা তিনজন রেংগুন যাওয়ার উদ্দেশ্যে বাড়ী থেকে পালিয়ে যাই। ফেনী রেলওয়ে স্টেশনে গাড়ীর অপেক্ষায় থাকাবস্থায় সাদা মামা নিরুদ্দেশ হয়ে যায়। ফলে আমার আর রেংগুন যাওয়া হয়নি। বিছিন্ন হয়ে যায় সাদা মামার সাথে আমার যোগাযোগ। দীর্ঘদিন পর ১৯৩৭ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালে সাদা মামা ফিরে আসেন। সে সময় তিনি অস্বাভাবিক ও অসংলগ্ন আচরণ করছিলেন।
সাদা মামার আপন ভাতিজা মাস্টার নুরুল আমিন সাদা মামা সম্পর্কে বলেন, আমি আমার বাবার মুখে শুনেছি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় তিনি বাড়ী আসেন। বাড়ী এসে আমাদের হালের একটি বড় গরু নিয়ে তিনি পরশুরামের গুথুমা আবদুল্লাহ শাহ (রঃ) এর মাজারে জবাই করেন। এরপর আবারও তিনি নিরুদ্দেশ হয়ে যান। তিনি ছিলেন বহু ভাষাবিদ। তিনি একাধারে বাংলা, ইংরেজী, উর্দূ, হিন্দি, আরবী ও বার্মিজ ভাষায় পারদর্শী ছিলেন।সাদা মামা সম্পর্কে শামসুল হক খদ্দর বলেন, ১৯৬৯ সালে ছাত্র গণআন্দোলনের সময় সাদা মামা বলেছিলেন, খান সেনারা এদেশ থেকে চলে যাবে। নির্বাচনে নৌকার জয় হবে। তারা ক্ষমতা ছাড়বেনা। দেশ ভাগ হয়ে যাবে। মুজিব প্রেসিডেন্ট হবে। সাদা মামার ভবিষ্যতবাণী পরবর্তীতে অক্ষরে অক্ষরে মিলে গিয়েছিল।
তিনি আরো বলেন, ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধের আগে সাদা মামা আমার হাতে একটি কাগজে অংকিত একটি ভাজ করা খাম দিয়ে বলেছিলেন, এটি যত্ন করে রেখে দে। খামটি আমার বালিশের কভারের ভিতরে রেখে দিয়েছিলাম। যুদ্ধ শুরু হলে আমি আগরতলা চলে যাই। সাথে আমার বাক্সপেটরার সাথে ওই বালিশও নিয়ে যাই। একদিন রাতে বালিশের কভার থেকে খামটি বের হয়ে যায়। তখন আমি এটি খুলে দেখি একটি ম্যাপ অংকন করা। সাদা মামা নিজের হাতে ম্যাপটি অংকন করেছেন। এতে দেখা যায়, পূর্ব পাকিস্থানের মানচিত্র নয়টি ভাগে বিভক্ত করা রয়েছে। ৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধে পুরো দেশকে নয়টি সেক্টরে বিভক্ত করে যুদ্ধ পরিচালনা করা হয়। পরে অবশ্য আরো দু’টি সেক্টর যুক্ত করা হয়েছিল।
১৯৭১ সালের আগস্ট মাসে যুদ্ধচলাকালীন সময়ে ফেনী মিজান রোডে সাদা মামা পাকিস্থানী সেনাদের গাড়ীর সামনে দাঁড়িয়ে যান। গাড়ী থেকে সেনা অফিসার নেমে এলে সেনাদের উদ্দেশ্যে সাদা মামা উর্দু ও ইংরেজীতে বলেন, তোরা আমার দেশ ছেড়ে চলে যা। তোরা জিতবিনা। মায়ের কোলে চলে যা। এসব কথা শুনে পাক সেনারা সাদা মামাকে গ্রেফতার করে নিয়ে যায়। সাদা মামাকে ফেনী কারাগারে নেওয়ার পর বাঙ্গালী জেলার তাকে রাখতে অপরাগতা প্রকাশ করে। জেলার আর্মিদের বলেন, এই ব্যক্তি একজন আধ্যাত্মিক সাধক। স্বাভাবিক মানুষ নন। ওনাকে এখানে রাখলে আরো বিপদ হতে পারে। তাকে দয়া করে ছেড়ে দিন। একথা শুনে পাক আর্মি অফিসার অনেকটা বিচলিত হয়ে পড়েন। তখন আর্মি অফিসার নমনীয় হয়ে বলেন, পৌরসভার চেয়ারম্যানের জিম্মায় তাকে ছেড়ে দেন। তখন অনেক রাত। সেসময় ফেনী পৌরসভার চেয়ারম্যান ছিলেন, মোহাম্মদ ইদ্রিস মিয়া সাথী কোম্পানী। সকালে পৌর চেয়ারম্যান সাথী কোম্পানী খবর পেয়ে ফেনী কারাগার থেকে সাদা মামাকে নিজের জিম্মায় গ্রহন করেন।
সাদা মামা উদ্ভট আচরণ করলেও উদাসীন ছিলেননা। মা, মাটি ও দেশের প্রতি তার ছিলো দূর্নীবার আকর্ষণ। ছিলেন একজন খাঁটি দেশপ্রেমিক ও বীর মুক্তিযোদ্ধা।
স্বাধীনতা যুদ্ধের পর শামসুল হক খদ্দর সাদা মামাকে বললেন, আমি ঢাকা যাবো। তখন তিনি বললেন, ঢাকায় টাকা আছে। তাড়াতাড়ি যা। আমি বললাম ঢাকায় টাকা থাকলে আমার কি? তখন সাদা মামা বললেন, টাকা পেলে আমায় কত দিবি? আপনি যা চান তাই দেবো। তখন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান প্রধানমন্ত্রী। আমি প্রধানমন্ত্রীর সাথে দেখা করলাম। সেসময় দলের নিবেদিত কর্মীদের বেঁচে বেঁচে বঙ্গবন্ধু টাকা দিচ্ছিলেন। আমি তা জানতামনা। আচমকা বঙ্গবন্ধু আমার হাতে একটি চেক দিলেন। ধারণার বাইরেও অনেক টাকা ছিলো। আমাকে বঙ্গবন্ধুর টাকা দেওয়ার বিষয়টি আমি না জানলেও সাদা মামা আগাম জেনেছিলেন।
আবদুর রহমান সাদা মামা নিজেকে খান বাহাদূর বলে ভাবতেন। তার ডাক নাম ছিলো ধন মিয়া। তার বিয়ে করার বিষয়টি অজানাই রয়ে গেছে। তার বিচরণ ছিলো ফেনী স্টেশন রোড ঘিরে। সেসময় স্টেশন রোড ছিলো জমজমাট। সারি সারি লাইব্রেরী ছিলো স্টেশন রোডে। রুক্ষ মেজাজী সাদা মামা হঠাৎ হঠাৎ চিল্লাচিল্লি শুরু করতেন। অকথ্য ভাষায় গালাগাল করতেন। বইয়ের দোকানে ঢুকে সব বই রাস্তায় ছুঁড়ে মারতেন। তখন সংশ্লিষ্ট দোকানদার ঠাঁয় দাঁড়িয়ে সাদা মামার পাগলামী দেখতেন। কিছুই বলতেন না। সবাই সাদা মামাকে সমীহ করতেন।
অধুনালুপ্ত দুলাল সিনেমার সামনে ইদ্রিছিয়া হোটেলের বাবুর্চি মোঃ ইউসুফ সাদা মামা সম্পর্কে বলেন, প্রায়ই তিনি গভীর রাতে হোটেলের রান্না ঘরে ঢুকতেন। ওনাকে দেখলে আমরা সেদিকে যেতামনা। ওনার মেজাজ সম্পর্কে আমরা জানতাম। একটু এদিক-সেদিক হলে সব কিছু তিনি পেলে দিবেন। এই ভয়ে থাকতাম সবসময়। একদিন আমি দেখলাম সাদা মামা অনেকগুলো বাইট্রা মরিচ নিয়ে (লাল মরিচ) তার চোখে ঘঁষছেন। এটা দেখে ভয়ে আমার হাত-পা অবশ হয়ে যাচ্ছিল। হঠাৎ আমার চোখাচোখি পড়ায় আমি ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করলাম, মামা এগুলোতো মরিচ। চোখে কেন মাখছেন?
তখন সাদা মামা বললেন, চোখেরে শাস্তি দিয়ের। হারামজাদা চোখ সারাদিন খারাপ জিনিস দেখে।
ফেনী পানি উন্নয়ন বোর্ডের তৎকালীন সহকারী ইঞ্জিনিয়ার এয়ার আহমেদ সরকার সাদা মামা সম্পর্কে বলেন, পাকিস্থানের সেনা শাসক জিয়াউল হকের বিমান দূর্ঘটনার আগের দিন সাদা মামা বলেন, হেতে বেশী উড়ের, হেতেরে হালাই দিয়ের! অবিশ্বাস্য হলেও সাদা মামার ভবিষ্যতবাণী সত্যে পরিণত হয়েছে। তৎকালিন পাকিস্থানের প্রেসিডেন্ট জিয়াউল হক সাদা মামার ভবিষ্যতবাণীর পরদিন বিমান দূর্ঘটনায় মারা যায়।
হক ডেকোরেটরের মালিক ওবায়দুল হক সাদা মামার আরেকটি অলৌকিক ঘটনার বর্ণনা দেন। তিনি বলেন, ১৯৮৪ সালে ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীকে হত্যার দু’দিন আগে সাদা মামা বলেছিলেন, আট গুলিতে ভারত শেষ। গুনে গুনে আট গুলি দিমু। একটাও কম দিমুনা। ঠিক তার দু’দিন পর ইন্দিরা গান্ধী নিজের দেহরক্ষীর ছোঁড়া আটটি গুলিতে ঝাঁঝরা হয়ে মারা যান।
এছাড়াও সাদা মামা যাকে যখন যেটা বলেছেন, ঠিক সে ঘটনাগুলো পরবর্তীতে মিলে গিয়েছে।
চট্রগ্রামের মিরেরসরাই ও সোনাগাজী বঙ্গবন্ধু অর্থনৈতিক অঞ্চল সম্পর্কে সাদা মামা বহু আগে ভবিষ্যত বাণী করে গেছেন। তিনি বলেছিলেন, দেশের শ্রেষ্ঠ শহর হবে ফেনীর দক্ষিনে। বঙ্গবন্ধু অর্থনৈতিক অঞ্চল চালু হলে ফেনী সোনাগাজী অঞ্চলই হবে বাংলাদেশের শ্রেষ্ঠ শহর।
সাদা মামাও ছিলেন, আধ্যাত্মিক সাধক পীরে পাগলা হযরত শাহ সূফী আমির উদ্দিন (রঃ) পাগলা মিয়ার শিষ্য। মৃত্যুর আগে সাদা মামা ওছিয়ত করে গেছেন, তাকে যেনো নিজ গ্রামে দাফন করা হয়। ১৯৯৩ সালের ৮ ফেব্রুয়ারী শবে বরাতের রাত শেষে ফজর ওয়াক্তে শাহ সূফী খান বাহাদূর আবদুর রহমান (রঃ) সাদা মামা ইহলোক ত্যাগ করেন। পরশুরামের চিতলিয়া ইউনিয়নের ধনীকুন্ডা গ্রামে শায়িত আছেন এই আধ্যাত্মিক সাধক। (চলবে)