ধর্ষণের শিকার ব্যক্তির ডাক্তারি পরীক্ষার প্রতিবেদন না পেলে ধর্ষণকারী শাস্তি এড়াতে পারে না বরং অন্য সাক্ষ্যের ভিত্তিতে তার সাজা দেওয়া যেতে পারে বলে একটি মামলার রায়ে জানিয়েছে হাইকোর্ট।
চৌদ্দ বছর আগে খুলনার দাকোপ উপজেলায় এক কিশোরী ধর্ষণের মামলায় দেওয়া রায়ে হাইকোর্টের এ বক্তব্য আসে। ২৭ ফেব্রুয়ারি এই রায় দেওয়া হলেও বুধবার পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশ হয়।
হাইকোর্ট বলেছে, শুধু ডাক্তারি পরীক্ষা না হওয়ার কারণে ধর্ষণ প্রমাণ হয়নি বা আপিলকারী ধর্ষণ করেনি, এই অজুহাতে সে (আসামি) খালাস পেতে পারে না। ভিকটিমের মৌখিক সাক্ষ্য ও অন্যান্য পারিপার্শ্বিক সাক্ষ্য দ্বারা আসামির বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণিত হলে তার ভিত্তিতেই আসামিকে সাজা প্রদান করা যেতে পারে।
খুলনার দাকোপ উপজেলায় এক কিশোরী ধর্ষণের মামলায় আসামি ইব্রাহিম গাজীর যাবজ্জীবন সাজা বহাল রেখে ২৭ ফেব্রুয়ারি এ রায় দেন বিচারপতি মো. রেজাউল হক ও বিচারপতি ভীষ্মদেব চক্রবর্তী।
আপিল শুনানিতে আসামি পক্ষের যুক্তি ছিল, আদালতের আদেশ থাকার পরও প্রসিকিউশন ভিকটিমের ডাক্তারি পরীক্ষা করেনি।
এ ছাড়া ভিকটিম তার মা ও দুই বোনকে সাক্ষী করেছিল, তাদের কেউ আদালতে সাক্ষ্য দেয়নি। একারণে আসামি খালাস পাওয়ার অধিকারী।
এ প্রসঙ্গে রায়ে বলা হয়, ভিকটিমের বাবা মসজিদের ইমাম। তার স্ত্রী একজন পর্দানশীল মহিলা। তিনি ধর্ষণের মতো অপরাধের ক্ষেত্রে সাক্ষী দিতে এসে বিব্রতকর প্রশ্নের সম্মুখীন হতে চাইবেন না, এটাই স্বাভাবিক। এই মামলার অপর দুজন (ভিকটিমের দুই বোন) গুরুত্বপূর্ণ সাক্ষী হিসেবে বিবেচিত। ঘটনার সময় তাদের ছিল যথাক্রমে ১৬ ও ১২ বছর। তখন তারা ছিল নাবালিকা ও অবিবাহিতা। এটা স্বাভাবিক যে সামাজিক প্রেক্ষাপটে তারাও অবান্তর অপ্রীতিকর প্রশ্ন ও ঝামেলা এড়ানোর জন্য মামলায় সাক্ষ্য দিতে আসবে না। তারা সাক্ষ্য দিতে না আসার কারণেই অভিযোগ প্রমাণিত হয়নি বলে ধরে নেওয়ার কোনো অবকাশ নেই।
ভিকটিমের ডাক্তারি পরীক্ষা না করানোর বিষয় তুলে ধরে রায়ের পর্যবেক্ষণে বলা হয়েছে, ২০০৬ সালের ১৫ এপ্রিল ঘটনা ঘটে। আর ডাক্তারি পরীক্ষার জন্য খুলনার নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল আদেশ দেন ওই বছরের ১৭ মে। অর্থাৎ ৩২ দিন পরে। যদি ভিকটিমকে ওই দিনই (যেদিন ট্রাইব্যুনাল আদেশ দেয়) ডাক্তারি পরীক্ষা করাও হতো, তবুও দীর্ঘদিন পর পরীক্ষা করার কারণে ধর্ষণের কোনো আলামত না পাওয়াটাই স্বাভাবিক ছিল। শুধু ডাক্তারি পরীক্ষা না করার কারণে প্রসিকিউশন পক্ষের মামলা অপ্রমাণিত বলে গণ্য হবে না।
খুলনার দাকোপ উপজেলায় ২০০৬ সালের ১৫ এপ্রিল ধর্ষণের শিকার হন ওই কিশোরী। এ ঘটনায় স্থানীয়ভাবে সালিশ হয়। পরে ১৭ এপ্রিল থানায় মামলা করতে গেলে পুলিশ মামলা নেয়নি। এরপর ২৩ এপ্রিল খুলনার নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালে নালিশি অভিযোগ করেন কিশোরীর বাবা।
১০ মে আদালত কিশোরীর জবানবন্দি গ্রহণ এবং ঘটনার অনুসন্ধান করতে দাকোপ থানার ম্যাজিস্ট্রেটকে আদেশ দেয়। এরপর ১৭ মে কিশোরীর ডাক্তারি পরীক্ষা করতে খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালকে নির্দেশ দেয় এবং আসামির বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করে।
পরবর্তীতে খুলনার নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল বিচার শেষে গত বছর ১৩ মার্চ রায়ে আসামিকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড এবং ২০ হাজার টাকা জরিমানা, অনাদায়ে আরও দুই বছরের বিনাশ্রম কারাদণ্ড দেয়।
সে রায়ের বিরুদ্ধে হাইকোর্টে আপিল করেন ইব্রাহিম কাজী। এই আপিলের উপর শুনানি শেষে হাইকোর্ট তার আপিল খারিজ করে রায় দেয়।
এ মামলায় রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল জান্নাতুল ফেরদৌসি রূপা। আসামিপক্ষে আইনজীবী ছিলেন আমিনুল হক হেলাল।